​​বেসিক ধারণা

ওপেন সোর্স ও ফ্রি সফটওয়্যার পরিচিতি

আমার সর্বশেষ লেখায় প্রকাশিত লেখায় ওপেন সোর্সের ইতিহাস নিয়ে ধারণা দিয়েছিলাম। আজকে ওপেন সোর্স ও ফ্রি সফটওয়্যারের সাথে বিস্তারিত পরিচয় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব।

 

তাহলে শুরু করা যাক একটি উদ্দীপক দিয়ে, মনে করুন আসন্ন ইদ উপলক্ষে আপনি একটি প্যান্ট কিনলেন দশ হাজার টাকা দিয়ে। প্যান্ট টি সুনামধন্য “আবুল” ব্র্যান্ডের। ঈদের ছুটিতে ঘুড়তে গিয়ে আবেগের বশে প্যান্ট খুলতে গিয়ে (!?) প্যান্টের বোতামটি ছিড়ে ফেললেন।

যাইহোক, এখন আপনি চলে গেলেন টেইলার্সের দোকানে প্যান্ট টি সার্ভিসিং করানোর জন্য। কিন্তু বিপত্তিটা ঘটল যখন টেইলার্সের কর্মি আপনাকে জানালো যে তারা এই প্যান্টের বোতামটি লাগাতে পারবে না। বোতামটি লাগাতে হলে অবশ্যই “আবুল” ব্র্যান্ডের নিজস্ব সার্ভিস সেন্টারে যেতে হবে। তা না হলে “আবুল গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজ” আপনার নামে ও সেই টেইলার্সের দোকানের নামে মামলা করে দিবে!

আপনি সেখান থেকে সরে গিয়ে চলে গেলেন “আবুল” ব্র্যান্ডের সার্ভিস সেন্টারে। তারা সার্ভিস চার্জ বাবদ আপনার কাছে নিলো পাঁচ হাজার টাকা (সেই টেইলার্সের দোকানে যেটার চার্জ সর্বোচ্চ দশ টাকা)। যাইহোক, বুকে চাপা দিয়ে আপনি পাঁচ হাজার টাকা খরচ করে প্যান্ট টি সার্ভিস করে ব্যবহার করতে লাগলেন।

তারপর ভাবলেন এত শখের প্যান্ট টির পিছে একটি পকেট রয়েছে, সাথে আরেকটি পকেট যোগ করলে দোষ কোথায়? কিন্তু পকেট লাগাতে গিয়ে আপনি “আবুল গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজ” প্রদত্ত একটি বার্তা পেলেন। যেখানে উকিল নোটিশ দেওয়া হলো যে, পকেট লাগালে তাদের প্যান্টের ডিজাইন নষ্ট হয়ে যাবে। তাই এই কাজ করলে আপনার নামে মামলা করবে।

পরিবর্তন না করেই আপনি সেটি ব্যবহার করতে থাকলেন। এরই মাঝে চিন্তায় আপনার কোমড়ের মাপ কমে গেলো। প্যান্টটি কোমড়ের সাথে শক্ত করে আটকানোর জন্য একটি বেল্ট ক্রয় করার ইচ্ছে পোষণ করলেন। কিন্তু আপনি জানতে পারলেন প্যান্ট টির সাথে যেন তেন বেল্ট ব্যবহার করতে পারবেন না, আপনাকে অবশ্যই “আবুল মার্কা দড়ি” ব্যবহার করতে হবে।

সবশেষে আপনি রেগে সিদ্ধান্ত নিলেন, এই প্যান্ট টি আর ব্যবহার না করে কোন ভুড়িওয়ালা মানুষকে দান করে দিবেন। কিন্তু সেখানেও রয়ে গেলো বিপত্তি, এই প্যান্ট টি বিতরণ করলেও কোম্পানী আপনার নামে মামলা করে দিবে।

কি? কথা গুলো শুনে উদ্ভট উদ্ভট লাগছে? কিছু কিছু সফটওয়্যারের ক্ষেত্রে বর্তমানে এরকম নিয়মই চলমান।

উদ্দীপকের এই প্যান্টের মত অনেক সফটওয়্যার ব্যবহার করার জন্য হরেক রকমের শর্ত জুড়ে দেওয়া থাকে। কেড়ে নেওয়া হয় ব্যবহার করার স্বাধীনতা। যারফলে আপনি নিজের ইচ্ছা মতো সংশোধন করতে পারেন না, যুক্ত করতে পারবেন না নতুন কোন সুবিধা, ইচ্ছা মত যে কোন ডিভাইসে ব্যবহার করার স্বাধীনতাও দেওয়া হয় না, এমনি কি আপনি নিজের ইচ্ছে অনুসারে বিতরণ করতে পারবেন না। এরকম সফটওয়্যার কে আমরা ক্লোজ সোর্স সফটওয়্যার বলে থাকি। উদাহরণঃ উইন্ডোজ, মাইক্রোসফট অফিস, ম্যাক ওস, গুগল ক্রোম, এডোবি ফটোশপ ইত্যাদি।

এগুলির সোর্স কোড উন্মুক্ত নয়। এর মধ্যে অনেকগুলো ব্যবহারের জন্য মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় করতে হয়। কোন সমস্যা তৈরী হলে আপনি তা কোডিং করে ঠিক করতে পারবেন না। করলেই আইনের মারপ্যাচে পড়তে হবে।

মনে করেন মাইক্রোসফট ইন্টারনেট এক্সপ্লোরারে ফায়ারফক্সের মতো মাল্টি একাউন্ট কনটেইনার সুবিধা নেই। আপনি একজন প্রোগ্রামার ও ভালো কোডিং পারেন। আপনাকে যদি এটির সোর্স কোড দেওয়া হয় তাহলে আপনি উক্ত সুবিধাটি যোগ করতে পারবেন। কিন্তু সেই স্বাধীনতা আপনাকে দেওয়া হয়নি। বা কোনভাবে সেটা করে ফেললেও মাইক্রোসফট আপনার উপর মামলা করার অধিকার রাখে।

 

ধরুন, আপনার এক বন্ধু প্রায় আশি হাজার টাকা খরচ করে তার ব্যবহারের জন্য “অটোক্যাড” নামক সফটওয়্যার টি কিনলো। আপনার নিজের ছোট্ট কাজের জন্য এটি দরকার, কিন্তু এত ছোট কাজের জন্য আপনি আশি হাজার টাকা খরচ করতে চান না। আপনি ভাবলেন আপনার বন্ধুর নিকট হতে “অটোক্যাড” নামক সফটওয়্যার নিয়ে কাজ টা সেরে ফেলবেন। কিন্তু আপনার সেই স্বাধীনতা টুকু নেই। কারন উক্ত সফটওয়্যার টি ক্লোজ সোর্স ও জটিল লাইসেন্স দ্বারা আবদ্ধ।  

তাহলে, বিনামুল্যের সফটওয়্যার ও ফ্রি সফটওয়্যার কি একই জিনিস?

যে সফটওয়্যার টি আপনি নিজের ইচ্ছে মত পরিবর্তন, পরিমার্জন, বিতরণ করতে পারবেন ও নিজের ইচ্ছে অনুসারে যে কোন ডিভাইসে সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে পারবেন (এই প্রয়োজনে অবশ্যই আপনাকে উক্ত সফটওয়্যারের সোর্স কোড দেওয়া হবে) সেটি হচ্ছে ফ্রি সফটওয়্যার। উদাহরণঃ লিনাক্স, মজিলা ফায়ারফক্স, উবুন্টু, লিব্রা অফিস, অ্যান্ড্রয়েড, ভিএলসি মিডিয়া প্লেয়ার ইত্যাদি।

অন্যদিকে যে সফটওয়্যার শুধু ব্যক্তিগত কাজে ফ্রি তে ব্যবহার করা যায় তবে কোড পরিবর্তন, পরিমার্জন করা যায় না সেটি হচ্ছে ফ্রিওয়্যার।

এক নজরে ওপেন সোর্স সফটওয়্যার, ফ্রি সফটওয়্যার ও ফ্রিওয়্যার –

ওপেন সোর্স সফটওয়্যার – ওপেন সোর্স সফটওয়্যার তাকেই বলা হয় যার সোর্স কোড উন্মুক্ত থাকে। সেটা ব্যবহারকারী নিজ ইচ্ছা স্বাধীন মত ব্যবহার করতে পারে। ওপেন সোর্স সফটওয়্যার বিনামুল্যে পাওয়া যেতে পারে, আবার মুল্য লাগতেও পারে। যেমন, ভিএলসি মিডিয়া প্লেয়ার বা লিব্রা অফিস আপনি ফ্রি তে পাবেন। আবার এটার সোর্স কোড উন্মুক্ত রয়েছে।

আবার, রেডহ্যাট লিনাক্স এন্টারপ্রাইজ বা সুসে এন্টারপ্রাইজ লিনাক্স ব্যবহারের জন্য আপনাকে কিছু টাকা খরচ করতে হবে। কিন্তু এটার সোর্স কোড উন্মুক্ত। আপনি চাইলে এটার সোর্স থেকে কম্পাইল করে নতুন কোন অপারেটিং সিস্টেম বানাতে পারবেন। ফলাফল স্বরুপ আমরা রেডহ্যাট লিনাক্স (ব্যবহার করতে টাকা লাগে) এর সোর্স কোডের উপর ভিত্তি করে তৈরী সেন্ট ওএস (ব্যবহারে কোন টাকা লাগে না) পাচ্ছি।

ফ্রি সফটওয়্যার এর সোর্স কোড উন্মুক্ত থাকে ও যে কেউ ব্যবহার, পরিবর্তন, সম্পাদন এবং সেটি বিতরণও করতে পারবে। এরকম সফটওয়্যার বেশীরভাগ কমিউনিটি দ্বারা পরিচালিত হয়। যেমনঃ মজিলা ফায়ারফক্স, লিব্রা অফিস, উবুন্টু ইত্যাদি।

ফ্রিওয়্যার – এই ধরণের সফটওয়্যার বেশীরভাগ ক্লোজড সোর্স হয়ে থাকে এবং এটি পরিবর্তন করার বা সোর্স কোড দেখার অনুমতি দেয় না। শুধুমাত্র ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ডাউনলোড করে ব্যবহার করার লাইসেন্স/অধিকার দেয় (ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য ব্যবহার করতে টাকার দিতে হতে পারে)। এই ধরণের সফটওয়্যারের মধ্যে গুগল ক্রোম একটি। এই ব্রাউজার আমরা বিনামুল্যে পাই কিন্তু এটি ফ্রি সফটওয়্যার নয়। এটি ব্যবহারের জন্য আপনার কাছে কোন টাকা না নিলেও এটির ডেভেলাপার ব্যবহার কারীর তথ্য নিয়ে থাকে।

ওপেন সোর্স / ফ্রি / মুক্ত সফটওয়্যার নিয়ে সচরাচর কিছু প্রশ্নের সম্মুখিন হতে হয় তা হলো –

প্রশ্নঃ যে সফটওয়্যার আমরা বিনামুল্যে পাই তাকেই কি ফ্রি সফটওয়্যার বলে?

উত্তরঃ ফ্রি সফটওয়্যার সেইটাকেই বলা হয়, যেটার সোর্স কোড উন্মুক্ত থাকে এবং নিজের ইচ্ছেমত ব্যবহার, পরিবর্তন ও পরিমার্জন করতে পারবেন। যেমনঃ মজিলা ফায়ারফক্স বা উবুন্টু। এগুলোর ভেতরেও অল্প কিছু সীমাবদ্ধতা থেকে যায় যা আপনি বিভিন্ন ওপেন সোর্স লাইসেন্স নিয়ে পড়লে বুঝতে পারবেন। তবে মদ্দা কথা, সোর্স কোড উন্মুক্ত থাকবে।

প্রশ্নঃ সফটওয়্যার টি ওপেন সোর্স কি না তা কি করে বুঝব?

উত্তরঃ অবশ্যই কোন সার্চ ইঞ্জিনের সাহায্যে এগুলির সোর্স কোড গিটহাবে অথবা অন্য কোন প্লাটফরমে আপনি পেয়ে যাবেন। এছাড়াও এটি কোন ওপেন সোর্স লাইসেন্স ব্যবহার করবে।

পরিশেষে আমরা বলতে পারি, সকল ফ্রি সফটওয়্যারই ওপেন সোর্স সফটওয়্যার। কিন্তু সকল ওপেন সোর্স সফটওয়্যার ফ্রি নয়।

পরবর্তি কোন সময়ে ওপেন সোর্স সফটওয়্যারের আরো সুবিধা নিয়ে লেখার চেষ্টা করব। আর কোনো বিষয় জানার থাকলে অবশ্যই কমেন্টে জানাবেন। আজকে এতটুকুই, ধন্যবাদ।

এই লেখাটি সম্পাদনা করা হয়েছে এপ্রিল ২২, ২০২০ ৬:৫৩ অপরাহ্ন

রায়হান আলী

পেশায় আমি একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। থাকি বাংলাদেশের ছোট্ট একটি বিভাগীয় শহর রাজশাহীতে। কর্ম ও বাসস্থল সবই এখানেই। প্রযুক্তি এবং ওপেন সোর্স কে ভালোবাসি। প্রযুক্তি আমার শখ ও অবসরের সঙ্গী। যখনই সময় পাই বিভিন্ন ওপেন সোর্স টুল, লিনাক্স ও ওয়েব নিয়ে ঘাটাঘাটি করি। আমি নিজের অবসর সময়ে প্রযুক্তি নিয়ে যা ধারনা অর্জন করি তা অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া পছন্দ করি। তাই মাঝে মাঝে প্রযুক্তি নিয়ে ছোটখাট লেখা লেখে ফেলি। চেষ্টা করে যাই নিজের স্বল্প জ্ঞান আপনাদের সাথে ভাগাভাগি করে নেওয়ার। আমার কন্টেন্ট নিয়ে কোন প্রশ্ন বা পরামর্শ থাকলে নির্দিধায় আমার সাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর মাধ্যমে যোগাযোগ করতে পারেন।

শেয়ার করুন
লিখেছেন

সর্বশেষ প্রকাশনা

প্রোগ্রামিং- সহজ নাকি কঠিন?

প্রোগ্রামিং শুরু করার আগে একটি প্রচলিত লাইন যা প্রায় সকল বিগিনারদের শুনতে হয়- "প্রোগ্রামিং খুব…

এপ্রিল ২৫, ২০২১

ডেনো এবং নোড জেএসের মধ্যে এখন পর্যন্ত কোনটির জনপ্রিয়তা বেশি?

ডেনো কি? ডেনো হচ্ছে জাভাস্ক্রিপ্ট ও টাইপস্ক্রিপ্টের একটি সিকিউর রানটাইম, এটি জাভাস্ক্রীপ্টের V8 ইঞ্জিন এবং…

জানুয়ারি ২৪, ২০২১

নেটওয়ার্কিং বেসিকস

অনেকেরই ধারণা ইন্টারনেট মানে একটি ম্যাজিকেল ক্লাউড যা আমাদের পছন্দের ওয়েবসাইট, অনলাইন শপ এবং অন্তহীন…

অক্টোবর ৪, ২০২০

পিএইচপি কি? কেন কিছু মানুষের কাছে এটি পছন্দনীয় নয়?

ওয়েবের ৭৮.৯% ওয়েবসাইটই পিএইচপি তে রান হওয়া স্বত্বেও এটি ভবিষ্যতের ইকোসিস্টেমের সাথে যাচ্ছেনা। বিশেষ করে…

সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২০

MySQL বনাম MongoDB ও এদের মধ্যে পার্থক্য

আমরা প্রত্যেকেই কম বেশি বিভিন্ন প্রয়োজনে সফটওয়্যার, ওয়েবসাইট এবং ওয়েব অ্যাপ ব্যবহার করে থাকি। এসকল…

জুলাই ১৮, ২০২০

ম্যালওয়্যার সম্পর্কে যা জানা জরুরী

ম্যালওয়্যার! বর্তমান সময়ে আসলেই একটি ভয়ের বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। বড় টেক কোম্পানী থেকে ছোট পার্সোনাল…

জুন ২৭, ২০২০