ডিজাইন

৫টি সেরা ওপেন সোর্স ডিজাইন সফটওয়্যার

আপনি যদি ফটোগ্রাফি করে থাকেন অথবা প্রফেশনাল গ্রাফিক ডিজাইনার হোন অথবা ওয়েব বা সফটওয়্যার ডিজাইনার হোন অথবা আপনি কোন প্রকৌশলী হয়ে থাকেন, আপনার জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয় জিনিস হচ্ছে একটি ডিজাইন সফটওয়্যার। আজকের পর্বে শুধুমাত্র গ্রাফিক ডিজাইন সফটওয়্যার নিয়ে আলোচনা করবো।

আপনি যদি গ্রাফিক ডিজাইনের কাজে শুধুমাত্র এডোবি ফটোশপ বা এডোবি ইলাস্ট্রেটর বা এডোবি লাইটরুম এর ভেতর কেবল মাত্র একটি ব্যবহার করে থাকেন তাহলে আপনাকে প্রতিমাসে গুনতে হবে ৩১.৩৯ ডলার। অথবা শুধুমাত্র ফটোগ্রাফি প্যাকেজ এডোবির ক্লাউড স্টোরেজ সহ ব্যবহার করেন তাহলে আপনাকে প্রতিমাসে গুনতে হবে প্রায় ৯.৯৯ ডলার।

আর যদি এডোবির সকল গ্রাফিক্স সফটওয়্যার ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে তাহলে আপনাকে প্রতিমাসে ৯৭.৪৯ ডলার খরচ করতে হবে যা বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৮ হাজার ৪০০ টাকা। যারা সবে মাত্র কাজ শিখছেন অথবা ছোটখাট স্টার্টআপ দাড় করানোর চেষ্টা করছেন তাদের জন্য এই টাকার সংখ্যাটি মোটেও কম নয়। এই টাকায় বাংলাদেশের একটি মফস্বল শহরে একজনের মাসিক খরচ বহন করা সম্ভব। আপনি যদি ক্র্যাক (পাইরেটেড) করে চালাতে চান সেটা সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়।

তবে Adobe বা Coral এর গ্রাফিক্স সুইট গুলোর আরেকটি সমস্যা হচ্ছে এগুলো লিনাক্স প্লাটফরমে সাপোর্টেড না। তাই আজকে আমি এমন কিছু গ্রাফিক্স সফটওয়্যার নিয়ে কথা বলব যা উইন্ডোজ, ম্যাক এবং লিনাক্স প্লাটফর্মে সাপোর্টে করে এবং ওপেন সোর্স। ওপেন সোর্স কি এবং এর ইতিহাস সম্পর্কে নিশ্চই আমাদের বিগত প্রকাশনা থেকে জেনেছেন।

১) গিম্প (GIMP)

গিম্প বা GIMP মানে দাড়ায় GNU Image Manipulation Program, তবে এটি রিলিজ হওয়ার সময় এটির নাম ছিলো General Image Manipulation Program। ১৯৯৫ সালে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া তে সেমিস্টার প্রজেক্ট হিসেবে এক্সপেরিমেন্টাল কম্পিউটিং ফ্যাসালিটির জন্য Spencer Kimball এবং Peter Mattis নামক দুইজন ভদ্রলোক গিম্পের ডেভেলপমেন্ট শুরু করেন।

পরের বছরে অর্থাৎ ১৯৯৬ সালে গিম্প প্রথম বারের মত সর্ব সাধারণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। সেই বছরেই রিচার্ড স্টলম্যান ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়াতে গিয়েছিলেন। Spencer Kimball এবং Peter Mattis স্টলম্যানকে GIMP এর নামের General এর স্থলে GNU ব্যবহারের প্রস্তাব দেন।

GNU রিচার্ড স্টলম্যানের তৈরী ওপারেটিং সিস্টেমের নাম। স্টলম্যান তাদের এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান। তারপর থেকে এটির নাম হয়ে যায় GNU Image Manipulation Program – GIMP এবং এটি হয়ে ওঠে GNU প্রজেক্টের অন্যতম একটি অংশ।

GIMP সাধারণত GNU এবং Gnome প্রজেক্টের ভলেন্টিয়ারদের দ্বারা ডেভেলপ করা হয়।

গিম্প কে একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ ডিজাইন সুইট এবং ইমেজ ইডিটর বলা হয়ে থাকে। এটির লেআউট ফটোশপের লেআউটের সাথে সামঞ্জস্যতা রয়েছে। নতুন ডিজাইনার গণও এক্সপার্ট ডিজাইনার গণ এটিকে ইমেজ ইডিটর হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন।

২) ক্রিটা (Krita)

ক্রিটার আইডিয়া টা আসে ১৯৯৮ সালে যখন KDE প্রজেক্টের ফাউন্ডার Matthias Ettrich গিম্পের জন্য Qt GUI এর তৈরী করেন। আগে থেকেই Qt বেজ ইমেজ ইডিটর হিসেবে KImage নামক একটি সফটওয়্যার ছিলো যা তৈরী করেছিলেন Michael Koch নামক একজন ভদ্রলোক (KOffice এর অংশ হিসেবে)।

১৯৯৯ সালে Matthias Ettrich একটি ইমেজ ইডিটর তৈরীর প্রস্তাবনা দেন যা Cobra নামক আর্কিটেকচার দ্বারা ImageMagic নামক ইমেজ ইডিটরের উপর বেজ করে তৈরী করা হবে। ট্রেডমার্কের ইস্যু এড়ানোর জন্য ক্রিটার নাম কয়েকবার পরিবর্তন করা হয়।

প্রথমে এটি KImageShop নামে প্রকাশ করা হলেও, তারপর এটির নামকরন করা হয় Krayon, এবং সর্বশেষে ২০০২ সালে এটির নামকরন করা হয় ক্রিটা “Krita”। সর্বসাধারণের জন্য এটিকে উন্মুক্ত করা হয় ২০০৪ সালে KOffice এর অংশ হিসেবে।

২০০৪ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ক্রিটাকে একটি ইমেজ ইডিটর হিসেবেই ডেভেলপ করা হচ্ছিলো। পরিবর্তন টা আসে ২০০৯ সালে যখন থেকে এটিকে “Coral Painter” এর মত পেইন্টিং এ্যাপ এর আদলে তৈরী করা শুরু হয়।

Krita একটি স্বয়ং সম্পুর্ণ পেইন্টিং অ্যাপ। আপনি চাইলে এটিকে ইমেজ ইডিটর হিসেবেও ব্যবহার করতে পারবেন। তবে পেইন্টিং এ্যাপ ও Coral Paint এর বিকল্প হিসেবেই বর্তমানে এটা বেশি জনপ্রিয়।

৩) ইংকস্কেপ (Inkscape)

ইংকস্কেপ ২০০৩ সালে ওপেন সোর্স প্রজেক্ট Sodipodi থেকে ফর্ক করে তৈরী করা হয়। বলে রাখা ভালো যে, Sodipodi প্রজেক্ট ১৯৯৯ সালে ডেভেলপ করা হয় যা আরেকটি ওপেন সোর্স সফটওয়্যার Gill (Gnome Illustration Application) কে বেজ করে তৈরী।

ইংকস্কেপ একটি ওপেনসোর্স ভেক্টর গ্রাফিক্স ইডিটর যাকে ইলাস্ট্রেটর অথবা কোরেল ড্র এর সাথে তুলনা করা যায়। ইংকস্কেপ ডিফল্টভাবে SVG ফরম্যাট ব্যবহার করে থাকে।

ইংস্কেপে ইলাস্ট্রেটরের মতই Rectangle, Ellipse, Gradient, Polygon ইত্যাদি টুলস আছে যা দ্বারা আপনি অনায়াসেই লোগো ডিজাইন, ব্যানার ডিজাইন, আইকন ডিজাইন ইত্যাদি কাজ সেরে ফেলতে পারবেন।

আপনি যদি লিনাক্স রিলেটেড বা অন্যান্য ওপেন সোর্স প্রজেক্ট সমুহের আইকনগ্রাফি বা ডিজাইন সমুহ যদি দেখেন তাহলে অনুমান করতে পারবেন যে, ইংকস্কেপ দ্বারা কোন পর্যায়ের ডিজাইন করা সম্ভব। এছাড়াও ইংকস্কেপ দ্বারা তৈরী কিছু ইলাস্ট্রেশন দেখতে পারবেন এইখানেঃ https://inkscape.org/gallery/

৪) ফন্ট ফোর্জ (Font Forge) –

ফন্টফোর্জ ২০০১ সালে George Williams নামক একজন ডেভেলপার তৈরী করেন। তিনি এটিকে ১২ বছর যাবৎ মেইনটেইন ও ডেভেলপ করেছেন। ২০১১ সালের মাঝের দিকে Dave Crossland নামক একটজন ডেভেলপার এটিতে কন্ট্রিবিউট করা শুরু করেন, এবং এটার সোর্স কোড কে সোর্সফোর্জ থেকে গিটহাবে নিয়ে যান।

এর পরবর্তিতে অনেকেই এই প্রজেক্টের সাথে যুক্ত হোন। এটি নিজস্ব একটি প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ ও পাইথন প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করে তৈরী করা হয়েছে। Font Forge সফটওয়্যারটি GUI (গ্রাফিকাল ইউজার ইন্টারফেস) ও কমান্ড লাইন উভয় থেকেই স্ক্রিপ্ট রান করতে পারে।

Font Forge অনেক ধরনের ফন্ট ফর্মেট সাপোর্ট করে। এটির নিজস্ব ফর্মেট .sfd (Spline Font Database) ছাড়াও TTF (True Type Font), TTC (True Type Collection), OTF (Open Type Format) সহ অনেক ধরণের ফন্ট ফর্মেট সাপোর্ট করে।

মজার বিষয় হচ্ছে, ২০১৪ সালে গুগলের আর্থিক সহযোগীতায় Frank Trampe নামক একজন ডেভেলপার এটিতে গুগলের UFO ফর্মেটের সাপোর্ট যুক্ত করেন।

ফন্টফোর্জ দ্বারা তৈরী কিছু বিখ্যাত ফন্টের নাম বলতে গেলে Asana-Math, Cantarell, DejaVu Fonts, Free USC Outline Fonts, Inconsolata, Junicode, Linux Libertine, M+ Fonts, OCR-A, Squarish Sans, XITS Font Project নাম নেওয়াই যায়।

৫) এস.ভি.জি-ইডিট (SVG-Edit):

এস.ভি.জি-ইডিট একটি ক্রস প্ল্যাটফর্ম টুল যা দ্বারা এস.ভি.জি (SVG) ফর্মেটের যে কোনো ফাইল ইডিট করা যায়। এটি জাভাস্ক্রিপ্ট দ্বারা তৈরী একটি ওয়েব টুল যা যে কোন ব্রাউজারে ব্যবহার করা যায় এবং ফায়ারফক্স বা ক্রোম বা ওপেরার মতো ব্রাউজারে এটিকে এক্সটেনশন হিসেবেও ব্যবহার করা যায়।

SVG-Edit ২০০৯ সালের ৬ ফেব্রুয়ারী Narendra Sisodiya নামক এক ডেভেলপারের হাত ধরে পথ চলা শুরু করে। ৩ জুন ২০১৯ এ এসে Pavol Rasnak নামক একজন ডেভেলপার এটির দ্বিতীয় ভার্শন (v 2.0) রিলিজ করেন। বর্তমানে এটির স্টেবল রিজিলের ভার্শন 5.0.0

আমার মতে এই সফটওয়্যার গুলো হচ্ছে সর্বোত্তম ওপেন সোর্স গ্রাফিক ডিজাইন সফটওয়্যার। আপনার মতামত যদি ব্যতিক্রম হয় তাহলে অবশ্যই আমাদেরকে কমেন্টে জানাবেন। এই লেখাটির পরবর্তী অংশে ওপেন সোর্স ইঞ্জিনিয়ারিং সফটওয়্যার গুলো সম্পর্কে আলোচনা করেছি।

এই লেখাটি সম্পাদনা করা হয়েছে এপ্রিল ২২, ২০২০ ৬:৩৪ অপরাহ্ন

রায়হান আলী

পেশায় আমি একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। থাকি বাংলাদেশের ছোট্ট একটি বিভাগীয় শহর রাজশাহীতে। কর্ম ও বাসস্থল সবই এখানেই। প্রযুক্তি এবং ওপেন সোর্স কে ভালোবাসি। প্রযুক্তি আমার শখ ও অবসরের সঙ্গী। যখনই সময় পাই বিভিন্ন ওপেন সোর্স টুল, লিনাক্স ও ওয়েব নিয়ে ঘাটাঘাটি করি। আমি নিজের অবসর সময়ে প্রযুক্তি নিয়ে যা ধারনা অর্জন করি তা অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া পছন্দ করি। তাই মাঝে মাঝে প্রযুক্তি নিয়ে ছোটখাট লেখা লেখে ফেলি। চেষ্টা করে যাই নিজের স্বল্প জ্ঞান আপনাদের সাথে ভাগাভাগি করে নেওয়ার। আমার কন্টেন্ট নিয়ে কোন প্রশ্ন বা পরামর্শ থাকলে নির্দিধায় আমার সাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর মাধ্যমে যোগাযোগ করতে পারেন।

মন্তব্য পড়ুন

শেয়ার করুন
লিখেছেন
ট্যাগঃ ওপেন সোর্স

সর্বশেষ প্রকাশনা

প্রোগ্রামিং- সহজ নাকি কঠিন?

প্রোগ্রামিং শুরু করার আগে একটি প্রচলিত লাইন যা প্রায় সকল বিগিনারদের শুনতে হয়- "প্রোগ্রামিং খুব…

এপ্রিল ২৫, ২০২১

ডেনো এবং নোড জেএসের মধ্যে এখন পর্যন্ত কোনটির জনপ্রিয়তা বেশি?

ডেনো কি? ডেনো হচ্ছে জাভাস্ক্রিপ্ট ও টাইপস্ক্রিপ্টের একটি সিকিউর রানটাইম, এটি জাভাস্ক্রীপ্টের V8 ইঞ্জিন এবং…

জানুয়ারি ২৪, ২০২১

নেটওয়ার্কিং বেসিকস

অনেকেরই ধারণা ইন্টারনেট মানে একটি ম্যাজিকেল ক্লাউড যা আমাদের পছন্দের ওয়েবসাইট, অনলাইন শপ এবং অন্তহীন…

অক্টোবর ৪, ২০২০

পিএইচপি কি? কেন কিছু মানুষের কাছে এটি পছন্দনীয় নয়?

ওয়েবের ৭৮.৯% ওয়েবসাইটই পিএইচপি তে রান হওয়া স্বত্বেও এটি ভবিষ্যতের ইকোসিস্টেমের সাথে যাচ্ছেনা। বিশেষ করে…

সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২০

MySQL বনাম MongoDB ও এদের মধ্যে পার্থক্য

আমরা প্রত্যেকেই কম বেশি বিভিন্ন প্রয়োজনে সফটওয়্যার, ওয়েবসাইট এবং ওয়েব অ্যাপ ব্যবহার করে থাকি। এসকল…

জুলাই ১৮, ২০২০

ম্যালওয়্যার সম্পর্কে যা জানা জরুরী

ম্যালওয়্যার! বর্তমান সময়ে আসলেই একটি ভয়ের বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। বড় টেক কোম্পানী থেকে ছোট পার্সোনাল…

জুন ২৭, ২০২০