আপনি প্রতিদিন হাজার হাজার মেসেজ বিভিন্ন জনের কাছে পাঠাচ্ছেন, আপনাকেও অনেকে মেসেজ পাঠাচ্ছে। কিন্তু আপনার কি ধারণা আছে আপনার মেসেজ আদান-প্রদানের মাঝে কি হচ্ছে? আপনার মেসেজিং এর উপর কেউ কি চোখ রাখছে? বাস্তবতা হচ্ছে আমরা ইন্টারনেট সার্ভিলিয়েন্স ও ডাটা লগিং এর যুগে বসবাস করছি। সিআইএ বা এফবিআই এর মত গোয়েন্দা সংস্থা গুলো ওত পেতে বসে আছে আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে নেওয়ার জন্য।
তাই বর্তমানে দিন দিন End to end এনক্রিপ্টেড মেসেজিং সার্ভিসের চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে। চাহিদার সাথে পাল্লা দিয়ে বিভিন্ন টেক কোম্পানী আমাদের জন্য বিভিন্ন রকমের এনক্রিপ্টেড মেসেজিং সার্ভিস তৈরী করছে। আজকে আমরা কিছু এনক্রিপ্টেড প্রাইভেট মেসেজিং সার্ভিস নিয়ে আলোচনা করব, যা দৈনন্দিন জীবনে আপনার তথ্যের আদান প্রদান কে গোপনীয় রাখতে সহায়তা করবে।
১। টেলিগ্রাম (Telegram)
টেলিগ্রাম সিকিউরিটি ও প্রাইভেসির জন্য অন্যতম পরিচিত একটি অ্যাপ। এটি কখনোই থার্ড পার্টি(৩য় মাধ্যম) কাওকে আপনার কোন তথ্য দেয় না। তথ্য না দেওয়ার কারনে অনেক দেশের সরকারের রক্ত-চক্ষুর মুখে পড়েছে টেলিগ্রাম।
মনে করেন হটাৎ আপনি পৃথিবীর সব মায়া ত্যাগ করে হিমালয়ে চলে গেলেন। সেখানে গিয়েও আপনি শান্তি পাবেন না, কারন আপনার ছেড়ে আসা বিভিন্ন মেসেজিং সার্ভিসের তথ্য গুলি বিভিন্ন হ্যাকার হ্যাক করে আপনার সম্পর্কে জানার চেষ্টা আজীবন চালিয়ে যেতে পারবে।
এটার সমাধান অবশ্য টেলিগ্রামে রয়েছে। আপনি নির্দিষ্ট একটা সময় বেধে দিতে পারবেন, এই কয়দিন আপনার একাউন্ট ইনএক্টিভ থাকলে আপনার একাউন্ট টি মুছে ফেলা হবে। এই ফিচারটিকে টেলিগ্রাম ব্যবহার কারীগণ “Self Destructing” নামে চিনে।
টেলিগ্রাম সম্পুর্ণ রুপে ওপেন সোর্স। এটির API (Application Programming Interface) উন্মুক্ত হওয়ায় এটির জনপ্রিয়তা আরো বেশি। এটি লিনাক্স, ম্যাক, উইন্ডোজ, আইওএস, অ্যান্ড্রয়েড, উইন্ডোজ ফোন, ব্রাউজার সহ প্রায় সকল প্রকার প্লাটফর্মের জন্য অফিসিয়াল/আন অফিসিয়াল ক্লায়েন্ট রয়েছে।
অন্যতম সুবিধা হচ্ছে, আপনি প্রাইভেট চ্যাটের মাধ্যমে সম্পুর্ণ গোপন ভাবে তথ্য আদান প্রদান করতে পারবেন। বার কোডের মাধ্যমে আপনার চ্যাট এনক্রিপ্টেড হয়েছে কি না তা নিশ্চিত হতে পারবেন। টেলিগ্রামের ভয়েস কল সুবিধা রয়েছে, যা সম্পুর্ণ এনক্রিপ্টেড। কথা বলার সময় প্রদর্শিত বিভিন্ন ইমোজি মিলিয়ে এনক্রিপশন সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারবেন। এছাড়াও টেক্স মেসেজ, ফাইল, ইমেজ, ভিডিও, অডিও, স্টিকার, লাইভ লোকেশন আদান প্রদান, গ্রুপ চ্যাট, চ্যানেলের সুবিধাও রয়েছে।
২। সিগনাল (Signal – Private Messenger)
সিগনাল গোপনীয় তথ্য আদান প্রদান করতে ইচ্ছুক মানুষদের কাছে অন্যতম জনপ্রিয় একটি মাধ্যম। এটিও একটি ওপেন সোর্স সফটওয়্যার। মেসেজ প্রদান কারী ও মেসেজ গ্রহণকারীর ভেতর উন্নত End-to-end এনক্রিপশন ব্যবহার করে। এটি অ্যান্ড্রয়েড, আইওএস, লিনাক্স, ম্যাক ও উইন্ডোজ প্লাটফরমের জন্য সিগনালের নিজস্ব ক্লায়েন্ট রয়েছে। সিকিউরিটি এক্সপার্টগণ এটির সোর্স কোড হতে এটির সিকিউরিটি নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে পারবেন।
সিগনাল এর মাধ্যমে আপনি আপনার বন্ধুদের মাঝে সম্পুর্ণ গোপনীয়তা রক্ষা করে ভয়েস কল করতে পারবেন, গ্রুপ চ্যাট করতে পারবেন, ফাইল আদান প্রদান করতে পারবেন। এবং সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে নির্দিষ্ট সময় পর মেসেজ অটোমেটিক ভাবে মুছে যায় এরকম অপশন বেছে নিতে পারবেন।
৩। থ্রিমা (Threema)
থ্রিমা একটি পেইড এনক্রিপ্টেড মেসেজিং সার্ভিস এবং ওপেন সোর্স সফটওয়্যার। এটি ব্যবহারের জন্য আপনাকে গুনতে হবে মাত্র ২.৯৯ মার্কিন ডলার। থ্রিমার মুল আকর্ষণ হচ্ছে আপনার কোন বন্ধুকে থ্রিমার মাধ্যমে মেসেজ পাঠানর জন্য তাকে কিউআর কোডের (QR Code) মাধ্যমে এড করতে হবে। কারন এটি ব্যবহারের জন্য কোন প্রকারের মোবাইল নাম্বার বা ইমেইল এড্রেসের প্রয়োজন হয় না। অর্থাৎ এই সার্ভিস আপনি সম্পুর্ণ গোপনীয়তা বজায় রেখে ব্যবহার করতে পারবেন।
থ্রিমার মাধ্যমে আপনি সম্পুর্ণ এনক্রিপ্টেড ভাবে ভয়েস কল, ভিডিও কল, ফাইল, টেক্সট ইত্যাদি আদান প্রদান করতে পারবেন। আপনার মেসেজ টি ডেলিভার হওয়ার সাথে সাথেই তা থ্রিমার সার্ভার থেকে ডিলিট হয়ে যায়। অর্থাৎ কেও যদি থ্রিমার সিইও কে বোম মারে উড়িয়েও দেয় তাহলে আপনার পাঠানো তথ্যটির কোন ছিটেফোটাও পাবে না। এটি অ্যান্ড্রয়েড, আইওএস, উইন্ডোজ ফোন ও ব্রাউজারে আপনি ব্যবহার করতে পারবেন।
৪। ডাস্ট (Dust)
ডাস্ট মেসেঞ্জারটিকে আরো এডভান্স লেভেলের সিকিউরিটির কথা চিন্তা করে তৈরী করা হয়েছে। এটি আগে সাইবার ডাস্ট নামে পরিচিত ছিলো। এটির মাধ্যমে End-to-end এনক্রিপ্টেড মেসেজ পাঠানো যায়। থ্রিমার মতো এটিও কোন মেসেজ তাদের সার্ভারে জমা রাখে না। এমনি কি, আপনি এমন অপশনও সেট করতে পারবেন যেন মেসেজ গ্রহণকারী মেসেজটি দেখার সঙ্গে সঙ্গে ফোন থেকে ডিলিট হয়ে যাবে। এছাড়াও এই অ্যাপের স্ক্রিনশট নিলে তা আপনাকে জানিয়ে দেওয়া হবে। ডাস্টের মাধ্যমে আপনি মেসেজ, স্টিকার, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন এবং এটি ফ্রি মেসেজিং সার্ভিস।
৫। সাইলেন্স (Silence SMS/MMS Encryption)
এটি একটি এনক্রিপ্টেড এসএমএস অ্যাপ। অর্থাৎ আপনার ফোনে থাকা ডিফল্ট SMS বা MMS অ্যাপটির মতোই এটিকে ব্যবহার করতে পারেন। আপনি এই অ্যাপের মাধ্যমে আরেকটি সাইলেন্স ইউজারকে এনক্রিপ্টেড এসএমএস বা এমএমএস পাঠাতে পারবেন। এর জন্য আপনার কোন একাউন্ট খোলার প্রয়োজন হবে না, ডাটা কানেকশনের দরকারও পড়বে না। এক্ষেত্রে আপনাকে সাধারণ এমএমএস বা এসএমএস এর খরচ বহন করতে হবে। আপনি যাকে এসএমএস বা এমএমএস পাঠাতে চান তার সাইলেন্ট অ্যাপ না থাকলেও সাধারণ টেক্সট মেসেজের মত তাকে মেসেজ পাঠাতে পারবেন। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে এটি ওপেন সোর্স। তাই যে কেও এর ভেতরে কোন সিকিউরিটি গত ত্রুটি আছে কি না তা যাচাই বাছাই করে দেখতে পারবে।
৬। হোয়াটসঅ্যাপ (Whatsapp)
হোয়াটসঅ্যাপ নিয়ে নতুন ভাবে কিছু বলার নেই। এটি লক্ষাধিক এন্ড্রয়েড ও আইওএস ব্যবহারকারীদের মাঝে প্রিয় একটি মেসেজিং এ্যাপ। হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহারকারীকে End-to-end এনক্রিপশন সুবিধা দিতে ২০১৪ সালে Open Whisper নামক একটি কোম্পানীর সাথে অংশীদারিত্বে যায়। এটির মাধ্যমে আপনি আপনার বন্ধুদের মাঝে ভয়েস মেসেজ, ছবি, ভিডিও পাঠানো সহ ভিডিও কল, গ্রুপ চ্যাট, লোকেশন শেয়ারের মত বিভিন্ন কাজ করতে পারবেন। এটি অ্যান্ড্রয়েড ও আইওএস প্লাটফরমে ব্যবহার করা যায়। এছাড়া এটির ওয়েব ইন্টারফেসের মাধ্যমে হোয়াটসএ্যাপের কিছু সিমীত সুবিধা ব্যবহার করা যায়।
বিধি বাম হলো, এটি ওপেন সোর্স নয় এবং সুবিধা হলো এটি ফ্রি সার্ভিস।
একটা বিষয় জেনে রাখা ভালো, সবচেয়ে বড় ভাইরাস হচ্ছে কম্পিউটার বা স্মার্ট ফোনের সামনে বসে থাকা মানুষটি। আপনার ছোটখাট ভুলের কারনেই আপনার ফোন, কম্পিউটার ভাইরাস বা মালওয়্যারের অাক্রান্ত হতে পারে। তখন এইসব মেসেজিং সার্ভিসও কোন কাজে আসবে না। এইখানে আমি আমার পছন্দ অনুসারে ছয়টি মেসেজিং সার্ভিসের নাম বলেছি। এরমধ্যে আপনার পছন্দের লিস্টে কোনটি রয়েছে এবং কোনটি ব্যবহার করেন তা অবশ্যই কমেন্ট সেকশনে জানাতে ভুলবেন না।
১ comment
টেলিগ্রাম ও ফেসবুক মেসেঞ্জার মূলত ব্যবহার করি, হোয়াটসঅ্যাপে অল্পস্বল্প।